প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি: কী পড়বেন, কীভাবে পড়বেন? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক একটি পরীক্ষা। বিশাল সংখ্যক পরীক্ষার্থী এতে অংশ নেয়, তাই চাকরিটি পেতে হলে একটি সুপরিকল্পিত ও গোছানো প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।
আপনার সুবিধার জন্য পরীক্ষার মানবন্টন, কী পড়বেন (সিলেবাস) এবং কীভাবে পড়বেন (কৌশল)—এই তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা নিচে দেওয়া হলো:
১. পরীক্ষার ধরন ও মানবন্টন বোঝা (The Big Picture)
প্রস্তুতি শুরুর আগে আপনাকে জানতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রটি কেমন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা মূলত দুটি ধাপে হয়:
• লিখিত পরীক্ষা (MCQ): ৮০ নম্বর
• মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা): ২০ নম্বর
লিখিত পরীক্ষার (৮০ নম্বর) বিষয়ভিত্তিক বিভাজন (সাধারণত):
• বাংলা (ব্যাকরণ ও সাহিত্য): ২০ নম্বর
• ইংরেজি (গ্রামার ও ভোকাবুলারি): ২০ নম্বর
• গণিত (পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি): ২০ নম্বর
• সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান ও আইসিটি): ২০ নম্বর
সতর্কতা: প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য সাধারণত ০.২৫ নম্বর কাটা হয় (নেগেটিভ মার্কিং)। তাই নিশ্চিত না হয়ে দাগানো বিপদজনক।
________________________________________
২. কী পড়বেন? (বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত সিলেবাস)
প্রাথমিকের প্রস্তুতিতে মূলত নবম-দশম শ্রেণির মান পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে গভীরতা বেশি লাগে।
ক. বাংলা (২০ নম্বর)
বাংলায় ব্যাকরণ অংশ থেকেই বেশি প্রশ্ন আসে। সাহিত্য অংশ থেকে তুলনামূলক কম প্রশ্ন হয়।
• ব্যাকরণ (গুরুত্বপূর্ণ):
o ভাষা, বর্ণ ও ধ্বনি প্রকরণ।
o বানান ও বাক্য শুদ্ধি (খুবই গুরুত্বপূর্ণ)।
o সন্ধি, সমাস, কারক ও বিভক্তি।
o প্রকৃতি ও প্রত্যয়।
o পদ প্রকরণ (বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি)।
o সমার্থক ও বিপরীত শব্দ, এককথায় প্রকাশ, বাগধারা।
• সাহিত্য:
o প্রাচীন ও মধ্যযুগ (চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন - বেসিক ধারণা)।
o আধুনিক যুগ: বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের জীবনী, তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থ ও চরিত্র (যেমন- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ)।
o মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্ম।
খ. ইংরেজি (২০ নম্বর)
ইংরেজিতে মূলত গ্রামারের বেসিক রুলস এবং ভোকাবুলারি থেকে প্রশ্ন আসে।
• Grammar Focus:
o Parts of Speech (Noun, Pronoun, Adjective, Verb, Adverb, Preposition, Conjunction) - এদের শনাক্তকরণ ও ব্যবহার।
o Tense & Right form of verbs (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ)।
o Articles (A, An, The).
o Number & Gender.
o Voice Change & Narration.
o Sentence Correction.
• Vocabulary Focus:
o Synonyms & Antonyms (বিগত সালের প্রশ্নগুলো আগে শেষ করবেন)।
o Correct Spelling.
o Idioms & Phrases.
o Appropriate Prepositions.
গ. গণিত (২০ নম্বর)
গণিতে ভালো করার মূল মন্ত্র হলো দ্রুত ও নির্ভুল অঙ্ক করা। এখানে পাটিগণিতের প্রাধান্য বেশি থাকে।
• পাটিগণিত (সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন আসে):
o সংখ্যা পদ্ধতি (বাস্তব সংখ্যা, মূলদ-অমূলদ)।
o লসাগু ও গসাগু।
o ঐকিক নিয়ম, গড়।
o শতকরা, লাভ-ক্ষতি, সুদকষা (সরল ও যৌগিক)।
o অনুপাত-সমানুপাত ও মিশ্রণ।
o বয়স সংক্রান্ত সমস্যা।
• বীজগণিত:
o মান নির্ণয় (বর্গ ও ঘনের সূত্রাবলী)।
o উৎপাদকে বিশ্লেষণ।
o সরল সমীকরণ ও অসমতা।
o সূচক ও লগারিদম (বেসিক)।
• জ্যামিতি:
o রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত সংক্রান্ত মৌলিক ধারণা, সংজ্ঞা এবং উপপাদ্য।
o পরিমিতি (ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয়ের সূত্র)।
ঘ. সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আইসিটি (২০ নম্বর)
• বাংলাদেশ বিষয়াবলী:
o বাংলাদেশের ইতিহাস (প্রাচীন কাল থেকে ১৯৪৭)।
o ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।
o মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা (খুবই গুরুত্বপূর্ণ)।
o বাংলাদেশের সংবিধান (গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ ও সংশোধনী)।
o ভৌগোলিক অবস্থান, নদ-নদী, জনসংখ্যা, জাতীয় অর্জন।
• আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী:
o বিভিন্ন মহাদেশ, বিখ্যাত প্রণালী, সীমারেখা।
o জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ (সদর দপ্তর)।
o সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (যুদ্ধ, চুক্তি, সম্মেলন)।
• দৈনন্দিন বিজ্ঞান:
o পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াবলী (যেমন- আলো, শব্দ, এসিড-ক্ষার, মানবদেহ, খাদ্য ও পুষ্টি, রোগব্যাধি)।
• তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT):
o কম্পিউটারের মৌলিক অংশ, ইনপুট-আউটপুট ডিভাইস, ইন্টারনেট, ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কিত সাধারণ জ্ঞান।
________________________________________
৩. কীভাবে পড়বেন? (প্রস্তুতির কৌশল)
শুধু সিলেবাস জানলেই হবে না, পড়ার ধরণ হতে হবে কৌশলগত।
ধাপ ১: বেসিক শক্তিশালী করা (Foundation Building)
• প্রাথমিকের প্রস্তুতির মূল ভিত্তি হলো এনসিটিবি (NCTB) এর পাঠ্যবই।
• বিশেষ করে ৫ম থেকে ৯ম-১০ম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ, গণিত এবং বিজ্ঞান ও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইগুলো ভালোভাবে পড়ুন।
• গণিতের উদাহরণ ও অনুশীলনী সব শেষ করুন।
ধাপ ২: বিগত সালের প্রশ্ন বিশ্লেষণ (Question Analysis)
• প্রস্তুতির শুরুতে একটি ভালো মানের "জব সল্যুশন" বা "প্রশ্ন ব্যাংক" কিনুন।
• গত ১০-১৫ বছরের প্রাথমিক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নগুলো ব্যাখ্যাসহ বুঝে পড়ুন।
• প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে বুঝবেন কোন টপিক থেকে বারবার প্রশ্ন আসে। সেই টপিকগুলো মার্ক করে বেশি জোর দিন।
ধাপ ৩: রুটিন মাফিক পড়াশোনা (Study Routine)
• প্রতিদিন অন্তত ৪-৬ ঘণ্টা পড়ার রুটিন তৈরি করুন।
• একদিনে সব বিষয় না পড়ে, প্রতিদিন অন্তত দুটি ভিন্ন বিষয় রাখুন (যেমন- সকালে গণিত, রাতে সাধারণ জ্ঞান)।
• গণিত ও ইংরেজি প্রতিদিন চর্চায় রাখতে হবে।
ধাপ ৪: নোট তৈরি ও রিভিশন (Notes & Revision)
• পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, সূত্র বা বারবার ভুলে যান এমন বিষয়গুলো ছোট ছোট করে নোটখাতায় লিখে রাখুন। পরীক্ষার আগে এই নোটগুলো খুব কাজে দেবে।
• সप्ताहের একদিন (যেমন শুক্রবার) রাখুন শুধু পুরো সপ্তাহে যা পড়েছেন তা রিভিশন দেওয়ার জন্য।
ধাপ ৫: মডেল টেস্ট ও সময় ব্যবস্থাপনা (Model Tests & Time Management)
• পরীক্ষার এক মাস আগে থেকে প্রচুর মডেল টেস্ট দিন।
• বাজারে প্রচলিত ভালো মানের মডেল টেস্ট বই বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পরীক্ষা দিতে পারেন।
• ৮০টি প্রশ্নের জন্য মাত্র ৬০ মিনিট সময় থাকে। তাই মডেল টেস্ট দিয়ে দ্রুত বৃত্ত ভরাটের অভ্যাস করুন এবং সময়ের সাথে প্রশ্নের ভারসাম্য করা শিখুন।
৪. প্রয়োজনীয় বই ও রিসোর্স
1. টেক্সট বই: ৫ম থেকে ১০ম শ্রেণির বোর্ড বই (বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, বাউবি)।
2. প্রশ্ন ব্যাংক: প্রফেসর’স, ওরাকল বা সাইফুর’স এর যেকোনো একটি প্রাইমারি প্রশ্ন ব্যাংক।
3. সহায়ক গাইড: বাজারের যেকোনো একটি স্বনামধন্য প্রকাশনীর পূর্ণাঙ্গ গাইড বই (সিলেবাসের টপিকগুলো গুছিয়ে পড়ার জন্য)।
4. সাধারণ জ্ঞান: প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা কারেন্ট ওয়ার্ল্ড এবং এমপি৩ (MP3) বা আজকের বিশ্ব এর মতো একটি বেসিক বই।
5. অনলাইন: গণিত ও ইংরেজির কঠিন টপিকগুলো বোঝার জন্য ইউটিউব টিউটোরিয়াল দেখতে পারেন।
৫. কিছু জরুরি পরামর্শ
• ধৈর্য ও ধারাবাহিকতা: এই প্রস্তুতি এক বা দুই মাসের নয়। ধৈর্য ধরে অন্তত ৪-৫ মাস একটানা লেগে থাকতে হবে।
• নেগেটিভ মার্কিং থেকে সাবধান: পরীক্ষায় সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। যেগুলো নিশ্চিত পারবেন, কেবল সেগুলোই দাগাবেন। লোভে পড়ে আন্দাজে দাগালে বিপদ বাড়বে।
• মানসিক স্বাস্থ্য: পড়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখুন।
পরিশেষে, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন। সঠিক পরিকল্পনা আর কঠোর পরিশ্রম করলে প্রাথমিকে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করা অবশ্যই সম্ভব। আপনার জন্য শুভকামনা!

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন