বাংলার ইতিহাস (১৭৫৭-১৯৪৭) পর্যন্ত - Daily Result BD

Breaking

মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫

বাংলার ইতিহাস (১৭৫৭-১৯৪৭) পর্যন্ত

বাংলার ইতিহাস (১৭৫৭-১৯৪৭) পর্যন্ত

খ-বিভাগ

১। ক্যাবিনেট মিশন কী ছিল?

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে, যা ক্যাবিনেট মিশন নামে পরিচিত। এই মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন ভারত গঠনের পথ তৈরি করা।

পটভূমি:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসে এবং ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে মত দেয়। এই প্রেক্ষাপটে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ভারতের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য তিনজন ক্যাবিনেট সদস্যকে ভারতে পাঠান। এই তিনজন সদস্য ছিলেন:

লর্ড পেথিক-লরেন্স (ভারত সচিব)

স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস (বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতি)

এ.ভি. আলেকজান্ডার (নৌবাহিনীর ফার্স্ট লর্ড)

মিশনের প্রস্তাবনা:

ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে একটি সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করে। তাদের প্রধান প্রস্তাবনাগুলো ছিল:

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো: ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গঠন করা হবে, যেখানে প্রদেশগুলোর হাতে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা থাকবে।

তিন স্তরবিশিষ্ট সরকার: কেন্দ্র, প্রদেশ এবং প্রদেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপ—এই তিন স্তরে ক্ষমতা ভাগ করা হবে।

সাংবিধানিক সভা: একটি সাংবিধানিক সভা গঠন করা হবে, যা ভারতের জন্য নতুন সংবিধান রচনা করবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

ব্যর্থতার কারণ:

ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতবিরোধ: কংগ্রেস একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার চেয়েছিল, অন্যদিকে মুসলিম লীগ প্রদেশগুলোর জন্য আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল।

গ্রুপিং ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক: প্রদেশগুলোকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করার প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়।

পাকিস্তানের দাবি: মুসলিম লীগ পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে অটল ছিল, যা ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।

ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা ভারতের বিভক্তিকে ত্বরান্বিত করে এবং এর ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।



২। ঔপনিবেশিক শাসন বলতে কী বুঝ?

ঔপনিবেশিক শাসন হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি শক্তিশালী দেশ অন্য একটি দুর্বল দেশের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করে এবং সেই দেশের সম্পদ শোষণ করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়ায়, দখলকারী দেশটি উপনিবেশের জনগণের উপর নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়।

ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য:

রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: উপনিবেশের শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি দখলকারী দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্থানীয় জনগণের কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকে না।

অর্থনৈতিক শোষণ: উপনিবেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন—খনিজ পদার্থ, কৃষিজাত পণ্য ইত্যাদি দখলকারী দেশে পাচার করা হয়। এছাড়া, উপনিবেশকে নিজেদের শিল্পপণ্যের বাজারে পরিণত করা হয়।

সাংস্কৃতিক আধিপত্য: দখলকারী দেশ নিজেদের ভাষা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি উপনিবেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়, যার ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বৈষম্য: ঔপনিবেশিক শাসকরা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা হয়।

উদাহরণ:

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন ঔপনিবেশিক শাসনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভারতে আসে এবং পরে ধীরে ধীরে পুরো উপমহাদেশে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করে। প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশরা ভারতের সম্পদ শোষণ করে এবং এখানকার জনগণের উপর নিজেদের শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়।

ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে উপনিবেশের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে এবং তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই বিশ্বের অনেক দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

৩। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলার কারণ কী?

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যদিও এটি সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হয়েছিল, তবে এর ব্যাপকতা, চরিত্র এবং লক্ষ্যের কারণে এটি একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।

প্রধান কারণগুলো হলো:

ব্যাপক অংশগ্রহণ: এই বিদ্রোহ শুধু সিপাহিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কৃষক, শ্রমিক, জমিদার, এবং বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের শাসকরাও এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গণ-আন্দোলন।

জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: এই বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের भावना তৈরি হয়। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, যা ভারতের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।

স্বাধীনতার লক্ষ্য: বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের সম্রাট হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। এটি প্রমাণ করে যে, এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন।

সর্বভারতীয় চরিত্র: বিদ্রোহটি উত্তর ও মধ্য ভারতের একটি বিশাল অংশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। দিল্লি, লখনউ, কানপুর, ঝাঁসি, এবং বেরেলির মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো ছিল বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র। এর সর্বভারতীয় চরিত্র এটিকে একটি জাতীয় সংগ্রামের মর্যাদা দিয়েছে।

ঐতিহাসিক তাৎপর্য: যদিও এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল, তবে এটি ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর ফলস্বরূপ, ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। এই বিদ্রোহ পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

অনেক ঐতিহাসিক, যেমন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, এই বিদ্রোহকে "ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, এটি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের প্রথম সংগঠিত এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ।

৪। অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের প্রাক্কালে বাংলাকে একটি পৃথক, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটি প্রচেষ্টা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, এবং আবুল হাশিমের মতো নেতারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। তবে বিভিন্ন কারণে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলো হলো:

কংগ্রেসের বিরোধিতা: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিল এবং তারা কোনোভাবেই বাংলা বিভাজনের বিরোধী ছিল। জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতো শীর্ষ কংগ্রেস নেতারা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন।

মুসলিম লীগের বিভক্তি: মুসলিম লীগের একটি অংশ, বিশেষ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুসারীরা, পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি বৃহত্তর বাংলা চেয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলা নয়। ফলে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ সমর্থনের অভাব ছিল।

হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা: হিন্দু মহাসভা এবং অন্যান্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবকে "মুসলিম আধিপত্য" প্রতিষ্ঠার একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিল। তারা বাংলার হিন্দু-প্রধান অংশকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য বাংলা ভাগের দাবি জানায়।

ব্রিটিশদের অনীহা: ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে চেয়েছিল এবং তারা একটি জটিল "তৃতীয় রাষ্ট্র" তৈরির প্রস্তাবে আগ্রহী ছিল না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেননি।

জনগণের সমর্থনের অভাব: সাধারণ হিন্দু ও মুসলিম জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ এতটাই তীব্র ছিল যে, তারা একটি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার ধারণার প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। ফলে এই আন্দোলনের কোনো গণভিত্তি তৈরি হয়নি।

বিলম্বিত উদ্যোগ: এই উদ্যোগটি অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছিল। যখন এই প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়, তখন ভারত বিভাগের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল, যা এই আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

এই সমস্ত প্রতিকূলতার কারণে, অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন ব্যর্থ হয় এবং ১৯৪৭ সালে বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করে পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানকে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতকে দেওয়া হয়।

৫। ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টির একটি ধারণা দাও।

কৃষক প্রজাপার্টি ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল, যা মূলত কৃষক এবং প্রজাদের (প্রজা বলতে এখানে ভাড়াটিয়া চাষিদের বোঝানো হয়েছে) স্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত হয়েছিল। এই দলের প্রধান নেতা ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক।

প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য:

১৯২৯ সালে "নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি" নামে এই দলের যাত্রা শুরু হয় এবং ১৯৩৬ সালে এর নামকরণ করা হয় "কৃষক প্রজাপার্টি"। দলের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো ছিল:

জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ: ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে কৃষকদের জমির মালিকানা প্রদান করা।

ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন: কৃষকদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করা।

অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা: বাংলায় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা।

প্রশাসনিক সংস্কার: স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

রাজনৈতিক সাফল্য:

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কৃষক প্রজাপার্টি অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। দলটি মুসলিম লীগকে পেছনে ফেলে বাংলার আইনসভায় একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। নির্বাচনের পর, এ. কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন এবং বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন।

অবদান:

ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজাপার্টি সরকার বাংলার কৃষকদের কল্যাণে একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (১৯৩৮): এই আইনের মাধ্যমে প্রজাদের অধিকার সুরক্ষিত করা হয় এবং জমিদারদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়।

ঋণ সালিশি বোর্ড আইন (১৯৩৬): এই আইনের মাধ্যমে হাজার হাজার কৃষক ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পায়।

শিক্ষা সংস্কার: বাংলায় অসংখ্য স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিক্ষার প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

উপসংহার:

কৃষক প্রজাপার্টি ছিল বাংলার ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক দল যা সরাসরি কৃষক ও সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেছে। এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে এই দলটি বাংলার রাজনীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা করে এবং কৃষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬। পরিচয় দাও: মীর কাসিম, মুন্সী মেহেরুল্লাহ, ফকির মজনু শাহ।

মীর কাসিম (Mir Qasim):

মীর কাসিম ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর জাফরের জামাতা এবং ১৭৬০ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত বাংলার নবাব। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও স্বাধীনচেতা শাসক।

ক্ষমতা লাভ: ১৭৬০ সালে ইংরেজদের সহায়তায় তিনি মীর জাফরকে সরিয়ে বাংলার মসনদে বসেন।

সংস্কার: নবাব হয়েই তিনি প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার আনেন। তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে (বর্তমান বিহার) স্থানান্তর করেন, যাতে ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা যায়।

ইংরেজদের সাথে সংঘাত: তিনি ইংরেজদের অবৈধ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের (দস্তক-এর অপব্যবহার) বিরোধিতা করেন এবং দেশীয় বণিকদের শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ দিয়ে ইংরেজদের একচেটিয়া বাণিজ্যে আঘাত হানেন।

বক্সারের যুদ্ধ: ইংরেজদের সাথে সংঘাতের জেরে ১৭৬৩ সালে তিনি পরাজিত হন এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে অযোধ্যার নবাব ও মুঘল সম্রাটের সাথে জোটবদ্ধ হয়েও ইংরেজদের কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। এই পরাজয় ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করে।

মুন্সী মেহেরুল্লাহ (Munshi Meherullah):

মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ববিদ।

সমাজ সংস্কার: তিনি মূলত বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণ এবং তাদের আধুনিক শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য কাজ করেন।

ধর্মীয় বিতর্ক: তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মীয় প্রচারের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক ও লেখনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে 'মেহেরুল ইসলাম' এবং 'খ্রিস্টান ধর্মের অসারতা'।

শিক্ষা বিস্তার: তিনি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।

উপাধি: তাঁর বাগ্মিতা ও সমাজসেবার জন্য তিনি 'মুন্সী' উপাধি লাভ করেন।

ফকির মজনু শাহ (Fakir Majnu Shah):

ফকির মজনু শাহ ছিলেন আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলায় সংঘটিত ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা।

নেতৃত্ব: তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং তাঁর নেতৃত্বে ফকির ও সন্ন্যাসীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে।

বিদ্রোহের কারণ: ইংরেজদের রাজস্ব নীতি, তীর্থযাত্রার উপর কর আরোপ এবং সাধারণ মানুষের উপর জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে এই বিদ্রোহ শুরু হয়।

কার্যক্রম: মজনু শাহ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ কুঠি ও তাদের অনুগত জমিদারদের কাচারি আক্রমণ করেন।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব: তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিদ্রোহ ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম দিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ আন্দোলন।

৭। সংক্ষেপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতি আলোচনা কর।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতিকে মূলত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়:

১. প্রাচ্যবাদী পর্যায় (১৭৬৫-১৮১৩):

উদ্দেশ্য: এই পর্যায়ে কোম্পানির নীতি ছিল প্রাচ্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের সহযোগিতা নিয়ে প্রশাসন পরিচালনা করা এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকে সম্মান জানানো।

কার্যক্রম: ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ সালে কলকাতায় কলকাতা মাদ্রাসা এবং জোনাথন ডানকান ১৭৯১ সালে বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

২. বিতর্ক ও সনদ আইন (১৮১৩):

বিতর্ক: ১৮১৩ সালের সনদ আইন পাসের সময় প্রাচ্যবাদী (Orientalist) এবং পাশ্চাত্যবাদী (Anglicist) দের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। প্রাচ্যবাদীরা দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতিতে শিক্ষা দেওয়ার পক্ষে ছিল, আর পাশ্চাত্যবাদীরা ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষাদানের পক্ষে ছিল।

আইন: ১৮১৩ সালের সনদ আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়।

৩. পাশ্চাত্যবাদী পর্যায় ও মেকলের মিনিট (১৮৩৫):

মেকলের মিনিট: ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে তাঁর বিখ্যাত মিনিট পেশ করেন, যেখানে তিনি ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। তিনি বলেন, "একমাত্র ইংরেজি ভাষাই ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারে।"

নীতি: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেকলের মিনিট গ্রহণ করেন এবং সরকারি শিক্ষানীতি হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেন।

ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিওরি: এই নীতির মাধ্যমে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এই আশায় যে, এই শিক্ষা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।

উপসংহার:

কোম্পানির শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ছিল এমন একদল কেরানি তৈরি করা যারা ইংরেজদের প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে ("A class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect")। তবে এই শিক্ষানীতির মাধ্যমেই ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদারনৈতিক ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়, যা পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্ম দেয়।

৮। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পটভূমি উল্লেখ কর।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস (Direct Action Day) ছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, যা মুসলিম লীগ কর্তৃক ব্রিটিশ সরকার এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান ছিল। এর পটভূমি ছিল মূলত ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা।

পটভূমি:

ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব (১৯৪৬): ব্রিটিশ সরকার ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ক্যাবিনেট মিশন পাঠায়। এই মিশন একটি ঐক্যবদ্ধ ভারত এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়।

মুসলিম লীগের সম্মতি প্রত্যাহার: প্রাথমিকভাবে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিলেও, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কিছু শর্ত আরোপের কারণে এবং জওহরলাল নেহেরুর কিছু মন্তব্যের ফলে মুসলিম লীগ মনে করে যে কংগ্রেস প্রস্তাবের মূল কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইছে। ফলে মুসলিম লীগ তাদের সম্মতি প্রত্যাহার করে নেয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে অচলাবস্থা: কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে রাজি হলেও মুসলিম লীগ এতে অস্বীকৃতি জানায়।

পৃথক রাষ্ট্রের দাবি: মুসলিম লীগ বুঝতে পারে যে আলোচনার মাধ্যমে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র অর্জন সম্ভব নয়। তাই ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই বোম্বেতে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়, যেখানে বলা হয় যে তারা সাংবিধানিক উপায়ে পাকিস্তান অর্জনের আশা ত্যাগ করে "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম" (Direct Action) শুরু করবে।

১৬ আগস্ট ঘোষণা: মুসলিম লীগ ১৬ আগস্টকে 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিবসের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল ও বিক্ষোভের মাধ্যমে পাকিস্তানের দাবিকে জোরালো করা।

ফলাফল:

মুসলিম লীগের এই আহ্বানের ফলে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, যা 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' নামে পরিচিত। এই দাঙ্গা দ্রুত বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারত বিভাজনকে অনিবার্য করে তোলে।

৯। ওহাবী ও ফরায়েজী আন্দোলনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।

ওহাবী ও ফরায়েজী আন্দোলন ছিল উনিশ শতকে বাংলায় সংঘটিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কার আন্দোলন, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরিত্র লাভ করে।

বৈশিষ্ট্য

ওহাবী আন্দোলন (নেতা: সৈয়দ আহমদ বেরলভী, বাংলায়: তিতুমীর)

ফরায়েজী আন্দোলন (নেতা: হাজী শরীয়তউল্লাহ, পরে দুদু মিয়া)

নামের উৎস

আরবের আবদুল ওয়াহাবের মতাদর্শ থেকে।

ইসলামের 'ফরজ' (অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) শব্দ থেকে।

প্রাথমিক প্রকৃতি

ধর্মীয় সংস্কার: ইসলামের বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনা, কুসংস্কার দূর করা এবং শিরক-বিদআত বর্জন করা।

ধর্মীয় সংস্কার: ইসলামের মৌলিক কর্তব্য পালনে গুরুত্ব দেওয়া এবং স্থানীয় কুসংস্কার দূর করা।

রাজনৈতিক প্রকৃতি

ব্রিটিশ বিরোধী: ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে 'দার-উল-হারব' (শত্রুর দেশ) ঘোষণা করে জিহাদের ডাক দেওয়া। তিতুমীরের নেতৃত্বে এটি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়।

জমিদার ও নীলকর বিরোধী: ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি এটি দ্রুত অর্থনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। হাজী শরীয়তউল্লাহর পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এটি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে।

সামাজিক প্রকৃতি

সামাজিক সমতা: মুসলিম সমাজের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা এবং অ-ইসলামিক রীতিনীতি বর্জন।

কৃষক স্বার্থ রক্ষা: কৃষকদের উপর জমিদার ও মহাজনদের শোষণ বন্ধ করা এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। দুদু মিয়া ঘোষণা করেন, "জমির মালিকানা আল্লাহর, তাই খাজনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।"

মূল লক্ষ্য

ভারতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ব্রিটিশদের বিতাড়ন।

বাংলার মুসলিম কৃষকদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক মুক্তি।

প্রকৃতির ব্যাখ্যা:

উভয় আন্দোলনই ছিল মূলত ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন। তারা চেয়েছিল মুসলিম সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করে ইসলামের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে। তবে, বাংলায় এই আন্দোলনগুলো দ্রুত কৃষক বিদ্রোহের রূপ নেয়। জমিদার, মহাজন এবং নীলকরদের শোষণ থেকে সাধারণ কৃষক ও কারিগরদের রক্ষা করার জন্য এই আন্দোলনগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা এবং দুদু মিয়ার 'লাঠিয়াল বাহিনী' গঠন প্রমাণ করে যে, এই আন্দোলনগুলো ছিল ঔপনিবেশিক শোষণ এবং স্থানীয় অত্যাচারী শ্রেণির বিরুদ্ধে এক ব্যাপক গণ-প্রতিরোধ।

১০। মুসলিম সমাজ সংস্কারে মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর অবদান কী ছিল?

মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) ছিলেন উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণে একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁর অবদান ছিল বহুমুখী:

১. ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ:

তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, যেমন—পীর পূজা, মাজার পূজা, এবং অ-ইসলামিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে জোরালো প্রচার চালান।

তিনি তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে ইসলামের মূল শিক্ষায় ফিরে আসার আহ্বান জানান।

২. খ্রিস্টান মিশনারিদের মোকাবিলা:

তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করেন। তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বহু বিতর্ক সভায় অংশ নেন এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'মেহেরুল ইসলাম' রচনা করেন।

তাঁর যুক্তিনির্ভর প্রচারের ফলে বহু ধর্মান্তরিত মুসলমান আবার ইসলাম ধর্মে ফিরে আসে।

৩. শিক্ষা বিস্তার ও আধুনিকতার প্রচার:

তিনি উপলব্ধি করেন যে, আধুনিক শিক্ষা ছাড়া মুসলিম সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি মুসলমানদেরকে ইংরেজি ও আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করেন।

তিনি বিভিন্ন স্থানে স্কুল, মাদ্রাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।

৪. সাহিত্য ও বাগ্মিতা:

তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বাগ্মী। তাঁর বক্তৃতাগুলো ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং জনমনে গভীর প্রভাব ফেলত।

তিনি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে মুসলিম সমাজের চিন্তা-চেতনাকে জাগিয়ে তোলেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম মুসলিম সমাজের মধ্যে জ্ঞানচর্চা ও আত্ম-সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।

উপসংহার:

মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর অবদান ছিল বাংলার মুসলিম সমাজের আত্ম-পরিচয় ও আত্ম-মর্যাদা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ধর্মীয় সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলার মুসলিমদেরকে আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে তোলেন।

১১। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ।

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন এবং তাদের অনুগত জমিদারদের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে ফকির (মুসলিম সুফি সাধক) ও সন্ন্যাসী (হিন্দু যোগী) দের সম্মিলিত সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন।

কারণ:

অর্থনৈতিক শোষণ: ১৭৭০ সালের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর কোম্পানির অতিরিক্ত রাজস্বের দাবি এবং জমিদারদের অত্যাচার।

তীর্থযাত্রায় বাধা: ফকির ও সন্ন্যাসীরা ঐতিহ্যগতভাবে তীর্থযাত্রা করত এবং স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করত। কোম্পানি ও জমিদাররা এই প্রথা বন্ধ করে দেয় এবং তীর্থযাত্রার উপর কর আরোপ করে।

কৃষকদের দুর্দশা: কোম্পানির নতুন ভূমি রাজস্ব নীতির ফলে সাধারণ কৃষক ও কারিগরদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

নেতৃত্ব ও প্রকৃতি:

নেতৃবৃন্দ: এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ। তাঁর মৃত্যুর পর মুসা শাহ, চিরাগ আলী শাহ এবং হিন্দু সন্ন্যাসীদের মধ্যে ভবানী পাঠকদেবী চৌধুরানী নেতৃত্ব দেন।

চরিত্র: এটি ছিল মূলত একটি কৃষক বিদ্রোহ যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ধর্মীয় সাধকরা। বিদ্রোহীরা কোম্পানির কুঠি, কোষাগার এবং জমিদারদের কাচারি আক্রমণ করত।

ব্যাপকতা: বিদ্রোহটি উত্তরবঙ্গ, বিহার এবং পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ফলাফল:

দীর্ঘ চার দশক ধরে এই বিদ্রোহ চলে। কোম্পানির সামরিক শক্তি এবং কঠোর দমননীতির ফলে বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। তবে এই বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং পরবর্তীতে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে এই বিদ্রোহের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।

১২। পরিচিত দাও: সৈয়দ আমীর আলী, সিরাজউদ্দৌলা।

সৈয়দ আমীর আলী (Syed Ameer Ali):

সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় মুসলিম আইনজ্ঞ, সমাজ সংস্কারক এবং ঐতিহাসিক।

আইনজ্ঞ: তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি ছিলেন। তিনি আইন ও বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অবদান: তিনি ১৮৭৭ সালে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায় করা এবং তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রচার করা।

ঐতিহাসিক ও লেখক: তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হলো: 'The Spirit of Islam' এবং 'A Short History of the Saracens'। এই গ্রন্থগুলো পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে এবং মুসলিমদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।

অবস্থান: তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতো মুসলমানদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতির বিরোধিতা করে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলেন।

সিরাজউদ্দৌলা (Siraj ud-Daulah):

সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩৩-১৭৫৭) ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি ১৭৫৬ সালে তাঁর নানা আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে বসেন।

নবাবী: তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। তাঁর স্বল্পকালীন শাসনকাল ছিল অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টায় পূর্ণ।

পলাশীর যুদ্ধ: ইংরেজদের সাথে তাঁর সংঘাতের প্রধান কারণ ছিল ইংরেজদের দুর্গ নির্মাণ, দস্তকের অপব্যবহার এবং তাঁর আদেশ অমান্য করা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়।

বিশ্বাসঘাতকতা: মীর জাফর, জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ এবং রাজবল্লভের মতো তাঁর প্রধান সেনাপতি ও সভাসদদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন।

ঐতিহাসিক তাৎপর্য: পলাশীর যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ছিল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা। তাঁর পতনের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

১৩। ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের ধারণাসমূহ লিখ।

১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। এই চুক্তির প্রধান ধারণাসমূহ বা শর্তাবলি নিম্নরূপ:

আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব: আইনসভায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, বরং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হবে। মুসলিমদের জন্য ৬০% এবং হিন্দুদের জন্য ৪০% আসন সংরক্ষিত থাকবে।

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় প্রতিনিধিত্ব: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোতে (যেমন: পৌরসভা, জেলা বোর্ড) মুসলিমদের জন্য ৬০% এবং হিন্দুদের জন্য ৪০% আসন সংরক্ষিত থাকবে।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ: সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের জন্য ৫৫% এবং হিন্দুদের জন্য ৪৫% পদ সংরক্ষিত থাকবে। তবে, এই কোটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মুসলিমদের জন্য ৮০% পদ সংরক্ষিত থাকবে।

ধর্মীয় স্বাধীনতা: উভয় সম্প্রদায় একে অপরের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান করবে। আইনসভায় কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয়ে কোনো বিল উত্থাপিত হলে, সেই সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তিন-চতুর্থাংশ সমর্থন ছাড়া তা পাস করা যাবে না।

মসজিদের সামনে বাদ্যযন্ত্র: মসজিদের সামনে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা গরুর মাংস সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আইনসভায় কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না।

উদ্দেশ্য:

এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা, যাতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই করা যায় এবং ভবিষ্যতে একটি স্বাধীন ভারতে উভয় সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে। তবে, চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর কংগ্রেসের একটি অংশ এই চুক্তি বাতিল করে দেয়, যা বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।

১৪। মুসলিম লীগ কেন গঠিত হয়েছিল?

নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে একাধিক কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল:

১. রাজনৈতিক কারণ:

মুসলিম স্বার্থ রক্ষা: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি মুসলিমদের অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। মুসলিম নেতারা মনে করতেন, কংগ্রেস মূলত হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ।

পৃথক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা: মুসলিম সমাজের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিল, যার মাধ্যমে তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারে।

২. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য:

মুসলিম লীগ গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা এবং সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানানো। এর মাধ্যমে তারা সরকারের কাছ থেকে মুসলিমদের জন্য বিশেষ সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিল।

৩. শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা:

মুসলিম সমাজ শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল। মুসলিম লীগ চেয়েছিল সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিমদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে এই অনগ্রসরতা দূর করতে।

৪. সাম্প্রদায়িক বিভেদ:

স্যার সৈয়দ আহমদ খানের 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' প্রভাব এবং বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক বিভেদ মুসলিম লীগ গঠনে অনুঘটকের কাজ করে। মুসলিম নেতারা মনে করেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলিমদের অস্তিত্ব ও অধিকার বিপন্ন হতে পারে।

৫. উদ্দেশ্যসমূহ (প্রাথমিক):

ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য বৃদ্ধি করা।

মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা এবং সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরা।

মুসলিমদের মধ্যে কোনো প্রকার বিদ্বেষ সৃষ্টি না করে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।

সংক্ষেপে, মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হিসেবে।

১৫। লক্ষ্মৌ চুক্তির ধারাসমূহ লেখ।

লক্ষ্মৌ চুক্তি ছিল ১৯১৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি জানাতে সম্মত হয়।

চুক্তির প্রধান ধারাসমূহ:

স্বায়ত্তশাসনের দাবি: উভয় দলই ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের জন্য স্বায়ত্তশাসন (Self-Government) বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস-এর দাবি জানায়।

আইনসভার সম্প্রসারণ: কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার দাবি জানানো হয়।

কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব: কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিমদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে।

পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা: মুসলিম লীগ কর্তৃক দাবি করা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কংগ্রেস মেনে নেয়। এই চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়।

বাংলায় মুসলিমদের জন্য ৪০% আসন।

পাঞ্জাবে মুসলিমদের জন্য ৫০% আসন।

যুক্তপ্রদেশে মুসলিমদের জন্য ৩০% আসন।

ভেটো ক্ষমতা: কোনো সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো বিল আইনসভায় উত্থাপিত হলে, সেই সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ সদস্য বিরোধিতা করলে বিলটি পাস হবে না।

ভাইসরয়ের ক্ষমতা হ্রাস: ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদে ভারতীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস করার দাবি জানানো হয়।

গুরুত্ব:

লক্ষ্মৌ চুক্তি ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় প্রধান রাজনৈতিক দল প্রথমবারের মতো একটি অভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সম্মত হয়, যা ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

১৬। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কি? এর কারণ সংক্ষেপে লিখ।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (The Great Bengal Famine of 1770):

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলতে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১১৭৬ সনে) বাংলায় সংঘটিত এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে বোঝানো হয়। বাংলা সনের নামানুসারে এটি 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (প্রায় এক কোটি মানুষ) অনাহারে মারা গিয়েছিল।

মন্বন্তরের প্রধান কারণসমূহ:

১. অনাবৃষ্টি ও ফসলহানি (প্রাকৃতিক কারণ): ১৭৬৮ ও ১৭৬৯ সালে বাংলায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি, যার ফলে মারাত্মক খরা দেখা দেয় এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

২. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ও রাজস্ব নীতি (রাজনৈতিক কারণ):

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি (রাজস্ব আদায়ের অধিকার) লাভ করে।

কোম্পানি রাজস্বের হার অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এমনকি ফসলহানির পরেও কোম্পানি জোর করে উচ্চহারে রাজস্ব আদায় করতে থাকে।

কোম্পানির কর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের জন্য কৃষকদের উপর চরম অত্যাচার চালায়।

৩. খাদ্য মজুত ও মুনাফাখোরি (অর্থনৈতিক কারণ):

কোম্পানির কর্মচারীরা এবং তাদের অনুগত দেশীয় বণিকরা বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত করে রাখে এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে।

কোম্পানি নিজেও ধান ও চালের ব্যবসায় একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে থাকে।

৪. কোম্পানির উদাসীনতা (প্রশাসনিক কারণ):

দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরেও কোম্পানি কোনো ত্রাণ বা সাহায্য কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। তারা কেবল রাজস্ব আদায়ের দিকেই মনোযোগ দেয়।

কোম্পানির দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে নবাবের হাতে ছিল নামমাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতা, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতে। ফলে কেউ জনগণের দায়িত্ব নেয়নি।

এই মন্বন্তর বাংলার অর্থনীতি ও সমাজকে পঙ্গু করে দেয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শোষণমূলক শাসনের ভয়াবহতা উন্মোচিত করে।

১৭। “পাঁচশালা বন্দোবস্ত” বলতে কি বুঝ?

পাঁচশালা বন্দোবস্ত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক ১৭৭২ সালে বাংলায় প্রবর্তিত একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা।

ধারণা:

সময়কাল: এই ব্যবস্থায় জমি নিলামে দেওয়া হতো এবং সর্বোচ্চ দরদাতাকে পাঁচ বছরের জন্য জমিদারি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেওয়া হতো। এই কারণে এটি 'পাঁচশালা বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত।

উদ্দেশ্য: দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে রাজস্ব আদায়ে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করে কোম্পানির রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য।

নিলাম ব্যবস্থা: জমিদারি নিলামে বিক্রি করার ফলে অনেক নতুন ধনী ব্যক্তি (যাদের কৃষিকাজ বা জমিদারি সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না) সর্বোচ্চ দর দিয়ে জমিদারি লাভ করে। এদেরকে 'ইজারাদার' বলা হতো।

সমস্যা:

অতিরিক্ত রাজস্বের চাপ: ইজারাদাররা সর্বোচ্চ দর দিয়ে জমিদারি নেওয়ায়, তারা কৃষকদের উপর অতিরিক্ত রাজস্বের চাপ সৃষ্টি করে।

কৃষকদের দুর্দশা: ইজারাদাররা পাঁচ বছরের মধ্যে নিজেদের লাভ তুলে নেওয়ার জন্য কৃষকদের উপর চরম শোষণ চালায়।

রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা: অনেক ইজারাদার অতিরিক্ত রাজস্বের চাপ সত্ত্বেও তা আদায় করতে ব্যর্থ হয় এবং পাঁচ বছর শেষ হওয়ার আগেই জমিদারি ছেড়ে পালিয়ে যায়।

জমির উর্বরতা হ্রাস: ইজারাদাররা জমির উন্নতির দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেবল শোষণ করত, ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়।

পাঁচশালা বন্দোবস্তের ব্যর্থতার কারণে ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৭ সালে এটিকে বাতিল করে একশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীতে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পথ তৈরি করে।

গ-বিভাগ

১। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ সম্পর্কে যা জান লেখ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিল।


দেওয়ানি কী?

দেওয়ানি বলতে বোঝায় রাজস্ব আদায়ের অধিকার এবং দেওয়ানি বিচার পরিচালনার ক্ষমতা। অর্থাৎ, এই অধিকার পেলে কোম্পানি সরাসরি বাংলা, বিহার ও ওড়িশার ভূমি রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক কার্যাবলীর একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।


পটভূমি ও ঘটনা

·         বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দ): ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব মীর কাসিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে। এই বিজয় ইংরেজদের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাকে অবিসংবাদিত করে তোলে।

·         এলাহাবাদের চুক্তি (১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ): যুদ্ধের পর, ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে রবার্ট ক্লাইভ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট একটি ঐতিহাসিক এলাহাবাদের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমেই কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে।

o    শর্ত: চুক্তির প্রধান শর্ত অনুযায়ী, মুঘল সম্রাট কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানির অধিকার বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করেন।

o    বাম্প্রতিদান: এর বিনিময়ে কোম্পানি মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদান করতে সম্মত হয় এবং অযোধ্যার নবাবের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া এলাহাবাদ ও কারা প্রদেশ দুটি সম্রাটকে সমর্পণ করে।

·         নবাবের ক্ষমতা: চুক্তির মাধ্যমে বাংলার নবাব নিয়ামত বা নিজামত (প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব) রক্ষার অধিকার পান, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের মতো মূল অর্থনৈতিক ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায়।


ফলাফল ও তাৎপর্য

·         দ্বৈত শাসন: দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈত শাসন (Dual Government) ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থায়:

o    কোম্পানি: পেল দেওয়ানির দায়িত্ব (রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ)।

o    নবাব: পেল নিজামত বা শাসনের দায়িত্ব (আইন-শৃঙ্খলা, ফৌজদারি বিচার ও প্রশাসন)।

o    ফল: এর ফলে কোম্পানির হাতে আসে ক্ষমতা (রাজস্ব আদায়), কিন্তু ন্যস্ত থাকে না দায়িত্ব (শাসন)। পক্ষান্তরে, নবাবের হাতে ছিল দায়িত্ব, কিন্তু ছিল না ক্ষমতা। এই ব্যবস্থা বাংলায় চরম অর্থনৈতিক শোষণ ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

·         অর্থনৈতিক শোষণ: দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করে এবং সেই অর্থ তারা ইউরোপে রপ্তানির জন্য ভারতীয় পণ্য ক্রয় করতে ব্যবহার করে (যা 'ডাস্ট' নামে পরিচিত)। এতে বাংলার অর্থনীতি দ্রুত দুর্বল হতে থাকে।

·         রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: দেওয়ানি লাভের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে একটি বাণিজ্যিক শক্তি থেকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় এবং ভারতে তাদের শাসনের পথ প্রশস্ত হয়।

দেওয়ানি লাভ ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক ঘটনা।

 

২। ওয়ারেন হেস্টিংসকে সংস্কারক হিসেবে মূল্যায়ন (৯০%)
ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings, গবর্নর-জেনারেল ১৭৭২–১৭৮৫) ইংরেজ ভারত শাসনে প্রথম কার্যকরী প্রশাসক হিসেবে বিবেচিত—বৃহৎ প্রশাসনিক, বিচারিক ও আর্ন্তজাতিক নীতির সূত্রপাত তারই সময়। তিনি কুঠুরি আইন-ব্যবস্থা পুনর্গঠন, রাজস্ব সংগ্রহে কিছু স্থায়ী নিয়ম অনুশীলন, স্থানীয় আইন ও রাজত্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করেন; বোস-আদালত প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরিচালনায় দক্ষতা দেখান। তবে তাঁর নীতিগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির রাজস্ব ও বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠা—স্থানীয় জনগণের কল্যাণ দ্বিতীয়িক। অতি ক্ষমতাবঞ্চিত বা দুর্নীতির ঘটনায় (যেমন: রাজা-নবাবদের নির্যাতন, ঘুষ-দুর্ব্যবহার অভিযোগ) তিনি বিতর্কিত হন; পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে তাকে বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয় (Impeachment)। সার্বিকভাবে তিনি আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো ও কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্য গঠনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু তাঁর নীতিগুলি উপনিবেশবাদের স্বার্থে নির্দেশিত—এটি তাঁর নেতিবাচক দিক। (সংক্ষেপে: প্রশাসনী দক্ষতা + উপনিবেশবাদী সীমাবদ্ধতা)।

৩। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের পটভূমি আলোচনা (১০০%)
পটভূমি: ১৮৭৭–১৯০০-র পরে ব্রিটিশ বাংলা—দখলদার কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব ও প্রশাসনে নতুন আলোকপাত প্রয়োজন; ১৯০৩–০৫ সালে বেনারস–বঙ্গীয় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও প্রশাসনিক দক্ষতা দাবির প্রেক্ষাপট ছিল। সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব: ব্রিটিশরা শতদলীয় স্বার্থ ও প্রশাসন-কেন্দ্রিকতা বাড়াতে চেয়েছিল—বেঙ্গলকে ক্ষুদ্র করার মাধ্যমে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে, আর একইসঙ্গে মুসলিম–হিন্দু জনাবলীর রাজনৈতিক শক্তি ব্যাহত হবে বলে ধারণা ছিল। কিংবদন্তি যুক্তি হিসেবে বলা হত যে পূর্ববঙ্গ (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ) ও পশ্চিমবঙ্গ (হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) আলাদা করলে প্রশাসনিক সুবিধা হবে। বাস্তবে লক্ষ্য ছিল উভয়ভাবে ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি ব্যবহার করে মুসলিম-হিন্দু ঐক্যকে দুর্বল করা এবং সদ্য-বর্ধিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্যানজট করা। ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া: ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জন ‘বেঙ্গল বিভক্ত’ ঘোষণা করেন; তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যাপক বিক্ষোভ, বয়কট, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ সৃষ্টি হয় — স্বদেশী আন্দোলন তীব্র হয় এবং ১৯০৫–১৯১১ পর্যন্ত জামানা উত্তাল থাকে। ১৯১১ সালে কলকাতা রাজ্যসভায় ঘোষণা করে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করা হয়—এটি ব্রিটিশ রাজনীতি ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে তীব্র করেছিল। সারসংক্ষেপ: প্রশাসনিক অজুহাতের আড়ালে রাজনৈতিক—সামাজিকভাবে বিভাজন করে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল ছিল মূল চালিকা শক্তি; ফলস্বরূপ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ শক্তিশালী হয়।

৪। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রধান ধারাগুলো বিশ্লেষণ (১০০%)
পটভূমি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক চাপ—ভারতে স্বশাসনের দাবি ও নানামত—ব্রিটিশরা ১৯১
۷–১৯১৯ তে কয়েকটি প্রতিশ্রুতি দিলেও (ডিফার্ড কনসটিটিউশনাল রিফর্ম) ১৯১৯ সালের আইন (Government of India Act 1919 বা Montagu-Chelmsford Reforms) এসেছে। প্রধান প্রযোজ্য ধারাসমূহ ও বৈশিষ্ট্য:

  • Dyarchy (দ্বিধাস্বত্ব ব্যবস্থা): প্রাদেশিক স্তরে সরকারি কাজ দুই ভাগে बाँटा—‘রিজার্ভড’ বিষয় (প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি রাজস্ব, বিচার) -> গভর্নরের অধীন; ‘ট্রান্সফারেবল’ বিষয় (কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় স্বশাসন) -> জনপ্রতিনিধি মন্ত্রিসভার মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
  • কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক ক্ষমতার ভাগ: কেন্দ্রীয় স্তরে কিছু নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা; প্রাদেশিক কাউন্সিল সম্প্রসারিত করা হয়; অংশগ্রহণ সীমিত ও স্বাস্থ্যকর ছিল না।
  • নির্বাচনী সম্প্রসারণ: আইনটি কায়েম করে একটি রূপে নির্বাচন সম্প্রসারিত করল—কিন্তু ইলেকটোরাল ভিত্তি শ্রেণিভিত্তিক ও সম্পত্তি-ভিত্তিক ছিল, সর্বজনীন ভোটনীতি ছিল না।
  • দক্ষ প্রশাসনিক কর্তৃত্ব রক্ষার চেষ্টা: গভর্নর এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের কাছে অনেক ক্ষমতা রেখে দেওয়া হয় (reserved powers), ফলে বাস্তবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সীমাবদ্ধতা ছিল।
  • আইনগত ও সংবিধানিক পরিবর্তন: কোর্ট ও প্রশাসনিক কাঠামোতে সামান্য পরিবর্তন; স্থানীয় সরকারের ভূমিকাও বাড়ে।
    বিশ্লেষণ: আইনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা ‘ধীরগতিতে স্বাধীনতা’—ধাপে ধাপে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দিলেও বাস্তবে ক্ষমতার মূল উৎস ও কল্পিত নিয়ন্ত্রণ বড় অংশে অক্ষত ছিল। Dyarchy-র ফলে প্রাদেশিক স্তরে বাস্তব নীতি চালনায় জটিলতা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়—জনপ্রতিনিধিরা অনেক বিষয়ে কার্যকর নাও হতে পারেন যখন গভর্নরের রিজার্ভড শক্তি আছে। ফলে এই আইন জাতীয়তাবাদীদের সন্তোষজনক ছিল না, বরং পরবর্তীতে কঠোর চাহিদা—সম্পূর্ণ স্ব-শাসন—উত্থিত হয়।

৫। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা (১০০%)
পটভূমি: ১৯৩৫ সালের Government of India Act—বৃহৎ ও শেষ উপনিবেশজনিত আইন—কিছুটা আধুনিক সংবিধানের আকার নিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে ক্ষমতার বিস্তৃতি দেয়। মূল বৈশিষ্ট্য:

  • ফেডারেল কাঠামো: কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বিভাজন (কিছু রাজ্য স্ব-শাসন ও কিছু সশস্ত্র ছিল)। তবে বাস্তবে কেন্দ্রীয়ভাবে শক্তিশালী রাখা হয়।
  • প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন: প্রদেশগুলোতে বিধানসভা ও মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠিত, প্রাদেশিক স্বশাসন বাড়ানো হয়েছে—Dyarchy প্রদেশ স্তরে প্রত্যাহার করা হয়েছে; প্রাদেশিক সরকারগুলোর ওপর ব্যাপক কর্তৃত্ব ও সংসদীয় ব্যবস্থা সোপানিকভাবে চালু হলো।
  • কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় শক্তিশালী গভর্নর-জনপ্রতিনিধিত্ব দ্বন্দ্ব: কেন্দ্রীয় গভর্নর ও সঞ্চালকরা বিশেষ শক্তি পেয়েছেন—‘Reserved subjects’ ও ‘Residuary powers’ কেন্দ্রেরই।
  • ভোটাধিকার সম্প্রসারণ: নির্বাচনী জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল (অর্থাৎ নির্বাচনী পরিধি বাড়ল), কিন্তু পুরোটাই সর্বজনীন ভোটদানের পর্যায়ে না।
  • আধুনিক প্রশাসনিক ও বিচারবিভাগ: কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো, রিপোর্টিং পদ্ধতি; ফেডারেল কোর্ট (পরে সুপ্রিম কোর্ট) প্রস্তাবিত ছিল।
    বিশ্লেষণ: আইনটি ব্রিটিশদের কাছে ‘লিগ্যাল ফেডারেলিজম’ হিসেবে কাজ করলেও বাস্তবে এটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে কিছু স্বায়ত্তশাসন দিল—ফলত: রাজনীতিতে আরও ছাত্রিত, দলীয় রাজনীতি গড়ে ওঠে, কংগ্রেস সরকার ১৯৩৭–৩৯ প্রাদেশিক নির্বাচনে নেতৃত্ব নেয়। আইনের সীমাবদ্ধতা ও ব্রিটিশ রিজার্ভ ক্ষমতা স্বাধীনতাকামীদের জন্য গ্রহণযোগ্য না হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতা-চাহিদা জোরালো করে।

৬। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ধারাসমূহ ব্যাখ্যা (১০০%)
পটভূমি: ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব (All-India Muslim League-এর দ্ব্যবার্ষিক সম্মেলনে, ২৩ মার্চ ১৯৪০; পয়গাম — ‘ডেক্লারেশন’)—এটি মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পৃথক রাষ্ট্রাভিলাষের প্রথম সুস্পষ্ট রাজনৈতিক নথি। প্রধান ধারাসমূহ:

  • ভারতীয় মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র: প্রস্তাবটি বলেছে যে ভারতবর্ষের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে (উপমণ্ডলীয়) স্বাধীন বা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা হোক—অর্থাৎ ‘পাকিস্তান’ ধারণার বীজ।
  • ভৌগোলিক ভিত্তি: লক্ষ করা হোক যে এমন অঞ্চলগুলো (উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব বাংলা/বেঙ্গল) যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেগুলো মিলিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি।
  • রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা: মুসলিমদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের নিশ্চয়তা দিতে আলাদা রাষ্ট্র অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ।
  • স্বেচ্ছাসেবী ও সংবিধানগত ব্যবস্থা: প্রস্তাবটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিল—যেখানে মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
    ব্যাখ্যা ও পরিণতি: লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ-ভারতীয় রাজনৈতিক ভূদৃশ্যে একটি ক্রান্তিকাল চিহ্নিত করে—কংগ্রেস ও অন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়ায় এবং প্রজাতন্ত্রকেন্দ্রি রাজনৈতিক আলোচনা শরীরভাগ করে। এটি পরবর্তীতে ১৯৪
    ۷ সালের ভাগাভাগির পথপ্রশস্ত করে; যদিও প্রস্তাবের নির্দিষ্ট কৌশল ও বাস্তবায়ন ব্যাপকবার বিবাদিত ও জটিল ছিল। সারসংক্ষেপ: লাহোর প্রস্তাব ছিল মুসলিম স্বায়ত্তশাসন-চাহিদার মানচিত্রগঠন—পরে এটি স্বাধীনতার আলোচনাকে দ্বিখণ্ডিত করে।

৭। রাজনৈতিক দল কি? ১৯০৬ সালের মুসলিম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বর্ণনা (১০০%)
(ক) রাজনৈতিক দল: সাধারণত রাজনৈতিক দল হল এমন একটি সংগঠন যেখানে কিছু লোক মিলিত হয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ, লক্ষ্য ও নীতিমালা নিয়ে কার্যক্রম করে—সরকার গঠন, নীতি প্রণয়ন, নির্বাচন অংশগ্রহণ, জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি উদ্দেশ্যে। দলগুলো ভোটব্যবস্থা, প্রচার, কর্মসূচি, নেতৃত্ব ও দাপ্তরিক কাঠামো নিয়ে থাকে।
(খ) ১৯০৬ সালের মুসলিম প্রতিষ্ঠা—বেক্ষণ (Muslim League প্রতিষ্ঠা, ১৯০৬): আল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ (All-India Muslim League) ৩০ ডিসেম্বর ১৯০৬-এ ডেক্কার সিংহাসনে (Dakha/Aligarh? — মূলত কলকাতার আলি–সভার প্রেক্ষাপট; ঐতিহাসিক উৎস বলছে মোনটো-লাইগু প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা/দায়াকার তফসিলে) প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ:

  • ব্রিটিশ-ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা করা; হিন্দু-অধিকাংশ শক্তির দ্বারে থেকে গৌরব-অধিকার রক্ষায় কাজ করা।
  • মুসলিমদের শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
  • আইনগত ও সংবিধানগত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাওয়া—সিট সংরক্ষণ, আলাদা ভোট, পৃথক প্রতিনিধি ব্যবস্থা প্রার্থনা।
  • মধ্যপন্থী নীতি: হিন্দু মজলিস বা কংগ্রেসের প্রভাব থেকে মুসলিম স্বার্থ আলাদা ও সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা।
  • ভবিষ্যতে, অধিকতর স্বায়ত্তশাসন বা সংবিধানজনিত সমঝোতার আলোচনায় মুসলিম ক্ষমতা-প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
    সংক্ষেপে: মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ, সংস্কৃতি ও শিক্ষা রক্ষা করা—পরে এর অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র দাবিতে পরিণত হয়।

৮। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে কি বুঝ? এর দোষগুণ আলোচনা (১০০%)
সংজ্ঞা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) হল ১৭৯৩ সালে ক্যালকাটা-ভিত্তিক রবার্ট ক্লাইভের উত্তরসূরী নীতির বদলে লর্ড কর্নওয়ালিস/রবার্ট ক্লাইভের অনুশাসনে ফেলি—বিশেষত লর্ড আল্ভানির বানাবে—কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে Permanent Settlement চালু করেন ডালহৌজি/ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রশাসক (বেঙ্গলে)। মূলত এটি জমিদারদের (zamindars) স্থায়ী কর-দায়িত্ব আরোপ করে; জমিদাররা জমির রাজস্ব সংরক্ষণ করে রাজস্ব সংগ্রহ করে কোম্পানির কাছে নির্দিষ্ট কিস্তি দেয়—অর্থাৎ জমিদারকে রাজস্ব সংগ্রাহক ও স্থায়ী মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।
গুণঃ

  • কোম্পানির রাজস্ব সংগ্রহে স্থিতিশীলতা ও নির্ভরযোগ্য আয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
  • প্রশাসনিক সরলতা: স্থানীয় বারবার সংগ্রহ ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি কেন্দ্রীয় ও স্থায়ী মাধ্যম তৈরি হয়।
  • জমিদারদের মধ্যে কিছু উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ দেখা দেয়; জমিদারশ্রেণীর প্রতিষ্ঠা ঐতিহাসিকভাবে ঘটে।
    দোষঃ
  • কৃষক-শোষণ বাড়ে: জমিদাররা চাপে রেখে কৃষককে উচ্চ কর/জমা-প্রথায় ব্যাহত করে, ফলে কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খারাপ হয়।
  • কৃষকরা জমির মালিকানা ও নিরাপত্তা হারায়; অনেক ক্ষেত্রেই ভোগদারী ও দাসত্বানুভব সমান্য হয়।
  • কৃষি উৎপাদন ও উন্নয়ন প্রণোদনা কম ছিল কারণ কৃষকরা তাদের বিনিয়োগের সঠিক স্বার্থ পাননি।
  • সমাজে অসাম্য ও সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী গঠন আরও দৃঢ় করা হয়।
    সারসংক্ষেপ: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কোম্পানিকে রাজস্বে স্থিতিশীলতা দিলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশীয় কৃষক শ্রেণীর জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়—ফলে এটি উপনিবেশকালীন বহু সামাজিক সমস্যার সূত্রপাত করে।

৯। বক্সারের যুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ; ফলাফল; কেন পলাশীর যুদ্ধের অপেক্ষা অধিক তাত্পর্যপূর্ণ বলা হয়? (১০০%)
(ক) পটভূমি: বক্সারের নীতি বা বক্সারের যুদ্ধ (১৯০০; Boxer Rebellion) চীনীয় জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলন যা পশ্চিমা এবং মিশনারি প্রভাব ও বিদেশী আধিপত্যের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। ১৮৯০–১৯০০ দশকে চীনে বিদেশি উপনিবেশ, মিশনারি কার্যক্রম ও অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশ (উদাহরণ: spheres of influence) ও রাজস্ব-চাপ—এই সব মিলিয়ে গ্রামীন ও শহরী মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সূচনা করে। বিশেষত বক্সাররা (Y
ìhéquán — “Righteous and Harmonious Fists”) বিদেশ ও মিশনারি বিরোধী হিংসাত্মক আক্রোশ দেখায়।
(খ) যুদ্ধের প্রধান ঘটনা ও ফলাফল:

  • ১৯০০ সালে বক্সাররা বেইজিং-এ পররাষ্ট্র মিশনারি ও বিদেশী কনস্যুলেট দখলের চেষ্টা করে; কিউংমিং (Empress Dowager Cixi) প্রাথমিকভাবে তাদের সহায়তা দেন বা নীরব সমর্থন ছিল।
  • দুর্নীতিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক মিলিত বাহিনী (আট দেশের কাসিম: যুক্তরাজ্য, জাপান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ইত্যাদি) চীনে অভিযান চালায় এবং বিদ্রোহ দমন করে।
  • চীনকে কঠোর শান্তি চুক্তি করতে হয় (Boxer Protocol, ১৯০১): বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, বিদেশী বাহিনী স্থাপিত হয়, কিছু শহরে বিদেশী প্রভাব স্থায়ী হয়।
    (গ) কেন পলাশীর যুদ্ধ অপেক্ষা অধিক তাত্পর্যপূর্ণ বলা হয়? (ইতিহাসে তুলনামূলক গুরুত্ব)
  • পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এশিয়া-ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে দেয়—ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্য ও উপনিবেশ স্থাপনে প্রায় সূচনালিপি হিসেবে কাজ করে। পলাশী যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশরা বাংলার প্রশাসনিক ও আর্থিক কুড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ পায়, যা পরবর্তীতে সমগ্র উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি গড়ে তোলে।
  • তুলনায় বক্সার যুদ্ধ ছিল আন্তর্জাতিক বিরোধ ও চীনের স্বশাসন-মধ্যস্থ সংকট, কিন্তু বিশ্বব্যাপী কলোনিয়াল নিয়ন্ত্রণে এই যুদ্ধ পলাশীর মতো স্থায়ী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নি। পলাশী যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ প্রভাব ক্ষমতায় ওঠা ও সাবেক শাসন ব্যবস্থার ধ্বংসের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে—এ কারণেই অনেক ইতিহাসবিদ পলাশী যুদ্ধকে অধিক তাত্পর্যপূর্ণ মনে করেন।

১০। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা; ফলাফল কী হয়েছিল? (৯৯%)
পটভূমি: বাংলা ও বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসন, কোম্পানির বর্ধিত বাণিজ্যিক স্বার্থ, ক্যালকাটা–ফরচুন–ট্রেড নিয়ে সংঘর্ষ বৃদ্ধি—স্থানীয় রিহাইত-নায়কদের (নেজা: রবার্ট ক্লাইভ, মিত্ররা) সঙ্গে ষড়যন্ত্রও ঘটেছিল; কোম্পানি ও স্থানীয় সহযোগীদের মধ্যে বিরোধ দাঁড়ায়। কোম্পানি সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে; নবাবের সাথে সংঘাত বাড়ে (কর্তৃপক্ষের কাস্টমস-নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য-অবরোধ ইত্যাদি)।
ফলাফল: ২৩ জুন ১৭৫৭-এ পলাশীতে বিজয়ী হওয়ার পর, কোম্পানি সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত করে; ফলত:

  • বাংলার ঈদ-রাজস্ব ও রাজস্ব-উপজয় কোম্পানির হাতে আসে (১৭৫৭–১৭৬৫ এ রাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনিক অধিকারের প্রথম পদক্ষেপ)।
  • কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা স্থানীয় শাসকদের কাছে নীতিগতভাবে প্রভাব বিস্তার করে—পরবর্তীতে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
  • স্থানীয় রাজনীতি ও সমাজে বড় পরিবর্তন: জমিদারী ব্যবস্থায় কোম্পানির ভূমিকা, কর ব্যবস্থা ও প্রশাসন বদলে যায়।
    (সংক্ষেপে: কোম্পানির রাজনৈতিক দখল ও উপনিবেশীক সত্যিকার সূচনা)। (৯৯%—একটু সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, কারণ আপনি ৯৯% চেয়েছেন)।

১১। ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের ধারাসমূহ; হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টায় এর গুরুত্ব (৯৯%)
পটভূমি: ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট (Bengal Pact) মূলত কোনো একক যৌথ চুক্তি হিসাবে বিখ্যাত—এই প্যাক্টটি প্রাদেশিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ও সংযুক্ত স্বার্থ নির্ধারণের একটা চেষ্টা ছিল। এটি সাধারণত বেঙ্গলীয় রাজনীতিতে সংবিধানিক এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সমঝোতার রূপে ধরা হয়।
প্রধান ধারাসমূহ (সারসংক্ষেপ):

  • প্রতিদিনের প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি সুবিধায় সংরক্ষণ ও কোটাও নির্ধারণ: সংখ্যালঘু (মুসলিম/হিন্দু) সুরক্ষায় নীতি।
  • শিক্ষা, চাকরি ও সরকারি পদে সম্প্রদায়ভিত্তিক বাধ্যবাধকতার সমাধান।
  • সংবিধানিক রূপে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টার ধারাবাহিকতা।
    গুরুত্ব (হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টায়): বেঙ্গল প্যাক্ট একটি মধ্যপন্থী, বিকল্প, অংশীদারিত্ব-ধর্মী উদ্যোগ ছিল যাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করে রাজনীতি শান্তিপূর্ণভাবে চালাতে পারা যায়—অর্থাৎ সমন্বিত প্রতিনিধিত্ব ও সামাজিক সমঝোতা তৈরিতে সহায়ক। তবে বাস্তবে রাজনৈতিক দুর্লভতা, জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা ও ভৌগোলিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েন প্যাক্টকে সীমাবদ্ধ করেছে—সেই কারণে এটি স্থায়ী ঐক্যের সমাধান হতে পারেনি। (৯৯%—অনেক তথ্য সংক্ষেপে পরিবেশন করা হয়েছে)।

১২। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের পটভূমি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা (৯০%)
পটভূমি: ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সংসদীয় আইন (Indian Independence Act 1947) দ্বারা ব্রিটেন ভারতের শাসন সমাপ্ত করে এবং সরাসরি দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান—ঘোষণা করা হয়; এটি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বর্ধিত পরিকল্পনা, লাহোর প্রস্তাব, ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনার ফল। রাজ্যগুলোর স্ব-নির্ধারণ, রাজ্যসমূহের অধীনে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি জটিলতায় আইনটি গৃহীত হয়।
বৈশিষ্ট্য (সংক্ষিপ্ত):

  • ভারত ও পাকিস্তান—দুই স্বাধীন ডোমিনিয়ন হিসেবে ব্রিটিশ রাজ্যের কাছে স্বাধীনতা লাভ করে (১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭—ইন্ডিয়া; পাকিস্তান ১৪/১৫ আগষ্ট)।
  • রাজ্যসমূহের অধিবাসী অধিকার, জমা-খণ্ড বিনিময় ও শরীফ-প্রশাসনিক বিষয়ে নিয়মাবলী নির্ধারিত হয় (প্রবাসী-বস্তিজনিত স্থানান্তর, নাগরিকত্ব সংক্রান্ত প্রাথমিক জটিলতা)।
  • সংবিধানিক পরিবর্তনে রাজপথ: বেসিকভাবে ব্রিটিশ আইন দ্বারা পরিচালিত হলেও নতুন রাষ্ট্রগুলো স্ব-লঙ্ঘনযোগ্য আইন প্রণয়ন করবে।
    (৯০%—সংক্ষেপে প্রধান পয়েন্টগুলিই তুলে ধরা হল; বিস্তারিত আইনি বক্তব্য ও ধারা বিস্তৃত।)

১৩। লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যালোচনা (৯০%)
(দ্রষ্টব্য: ৬ নম্বরে লাহোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করা হয়েছিল; এখানে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা)
মূলে: লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) — মুসলিম লীগের দাবি, পৃথক রাষ্ট্রের ধারণা, মুসলিম স্বার্থরক্ষার নীতিগত ভিত্তি; বৈশিষ্ট্যগুলো: ভৌগোলিক ভিত্তিক পৃথক রাজ্য, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন।
পর্যালোচনা (সংক্ষেপ): প্রস্তাবটি মুসলিম সমর্থকদের মধ্যে শক্তি দেয়, তবে জাতীয় স্তরে বিভাজন ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়ায়; এর কৌশলগত বাস্তবায়ন ও রাজ্যভিত্তিক জটিলতা পরবর্তীতে দু’দেশে সম্মুখীন হয়। (৯০%—সংক্ষিপ্ত, কারণ পূর্বেই বিস্তারিত আছে)

১৪। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার উল্লেখপূর্বক দেশ বিভাগে রাজনীতিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা মূল্যায়ন (৯০%)
পটভূমি: লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন (Lord Mountbatten) ১৯৪৭ সালে ভারতের শেষ ভাইসরয় ছিলেন; তিনি দ্রুতগতিতে ভারতের বলবৎ স্বাধীনতা ও বিভাজন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেন—‘June 3 Plan’ বা ‘Mountbatten Plan’ (প্রকৃত সিদ্ধান্ত ৩ জুন ১৯৪৭) এর মাধ্যমে।
ভূমিকা ও মূল্যায়ন:

  • দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ: তিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট তারিখ লক্ষ্য করে দ্রুত ব্রিটিশ প্রস্থান নির্ধারণ করেন—এর ফলে রাজনৈতিক আলোচনার সময়সীমা সংকুচিত হয়।
  • ভাগাভাগির নিয়ম ও রুট মেনে চলা: তিনি কেন্দ্র ও প্রদেশ দুই স্তরে যে রূপরেখা দিলেন (Boundary Commission, অর্থাৎ লর্ড মাউন্টব্যাটেন-উপর্যুপরি কমিশন প্রস্তাবিত) তা বাস্তবে বিভাজন ও সীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
  • সমালোচনা: দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সুশৃঙ্খল জনসংহার বিন্যাস করতে না পারা—শরণার্থী সংকট, সাম্প্রদায়িক হিংসা বহু এলাকায় বিস্তার লাভ করে; boundary commission-এর কাজ ও লাইন–ড্রয়িং-এর ফলে অনিয়ম এবং মানবিক বিপর্যয় ঘটে।
    সারমর্মে: মাউন্টব্যাটেন দ্রুত ও কার্যকরভাবে ব্রিটিশ প্রস্থান বাস্তবায়ন করেছিলেন—তবে তাঁর দ্রুত কার্যকরী কৌশল রাজনৈতিক ও মানবিকভাবে দুষ্প্রভবও সৃষ্টি করে; তাই মূল্যায়ন মিশ্র—সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা আছে, মানবিক প্রস্তুতিতে ব্যর্থতা রয়েছে। (৯০%—সংক্ষেপে)

১৫। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পটভূমি ব্যাখ্যা (৯৯%)
পটভূমি: দীর্ঘকালীন ধর্মীয় রাজনীতি, কংগ্রেস–মুসলিম লীগের মধ্যকার প্রত্যাবর্তনীয় দ্বন্দ্ব, লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০), বার্ষিক আন্দোলন, ১৯৩০–৪০-এর দশকে রাজনীতির মাঝখানে ব্রিটিশ কৌশল—সব মিলে বিভাজনের পথ প্রশস্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর আর্থিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ১৯৪৬-এর সংগ্রাম (Direct Action Day 1946), গ্রুপ
হিংসা ও রাজ্য পর্যায়ে প্রশাসনিক অকার্যকারিতা—এইগুলো শীর্ষে এসে বিভাজনের সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ত্বরান্বিত সমাধান এবং Boundary Commission-এর সীমা-রেখা প্রক্রিয়া ১৯৪৭ সালে বিভাজনকে বাস্তবে রূপ দেয়। ফলাফল: ব্যাপক জনহত্যা, প্রবাসী-সংস্কার (mass migration), রাজনৈতিক-বৈষম্য ও দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা। (৯৯%—প্রায় পূর্ণ বিশ্লেষণ সংক্ষিপ্তীকৃত)

১৬। বাংলায় তিতুমীরের আন্দোলনের স্বরূপ বিচার (১০০%)
পটভূমি: তিতুমীর (Titu Mir; পূরন নাম: টিটু মীর, ১৮১২–১৯৩১?) — (ইতিহাসগত রেকর্ডে: তিতুমীর, আসল নাম: তিতুমীর মোল্লা? সাধারণভাবে তিতুমীরকে ১৮২০–১৮৩১ সালের বাংলার জননেতা বলা হয়) তিনি গ্রামীন মুসলিম সমাজের অসহায়তা ও জমিদারী কঠোরতা, ব্রিটিশ আইন-শাসন ও মিশনারি-প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বৈশিষ্ট্য:

  • ধর্মীয় ও সামাজিক পুনরুজ্জীবন: তিনি ইসলামী-উদ্যোগে সামাজিক নৈতিকতা ও সামুদায়িক ঐক্য জোরদার করেন—মসজিদ-ভিত্তিক সংগঠন ও সামাজিক শৃঙ্খলা গঠন।
  • সশস্ত্র প্রতিরোধ: তিতুমীরের আন্দোলন সশস্ত্র অভিমুখী—তিনি গ্রামীণ জনসমর্থন নিয়ে স্থায়ী কেমন সশস্ত্র শক্তি তৈরি করেন এবং স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজি অভিযোজকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান (যেমন বহু জমিদার-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াই)।
  • সমাজে প্রভাব: তিতুমীর সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক স্বাধীনতার ধারণা ও জমিদার-শোষণবিরোধী আন্দোলনকে উসকে দেন; তিনি অলঙ্ঘ্য নীতি ও আত্ম-নিয়মিত জীবনচর্চা প্রচার করেন।
  • ফলাফল: তাঁর আন্দোলন ব্রিটিশ ও জমিদারী শক্তি দ্বারা শাসিত হয়, শেষপর্যন্ত তিনি ধরা পড়েন/হত্যা বা স্থায়ীভাবে দমন করা হয়; তবু তাঁর প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম পরবর্তী জাতীয় ও সামাজিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
    বিচার: তিতুমীরের আন্দোলন ছিল ধর্মীয়-সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে গ্রামীণ সশস্ত্র প্রতিরোধ—এটি বাংলার গ্রামীণ সমাজে ঐতিহাসিকভাবে প্রভাব ফেলেছিল এবং পরবর্তী সামাজিক আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়।

১৭। বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণে সৈয়দ আমীর আলীর ভূমিকা আলোচনা (৯০%)
(নোট: এখানে সম্ভবত আপনি 'সৈয়দামীর আলী' বলতে চাইছেন — ঐতিহাসিকভাবে সৈয়দ এমিল আলী/সৈয়দ আমীর আলী (Syed Ameer Ali, ৪ জানুয়ারি ১৮৪৯–১৯২৮) ছিলেন প্রখ্যাত মুসলিম আইনজীবী, বিচারক, লেখক ও শিক্ষানীতিক প্রবর্তক।)
ভূমিকা ও অবদান:

  • গবেষণা ও লেখনী: সৈয়দ আমীর আলী মুসলিম ইতিহাস, ইসলাম ও আধুনিক বাংলা-ভারতীয় প্রেক্ষাপটে মুক্ত চিন্তার প্রচার করেন—তাঁর লেখনী মুসলিম সমাজকে আধুনিকতা গ্রহণ ও ঐতিহ্য রক্ষার মধ্যে সামঞ্জস্য করতে সাহায্য করে।
  • রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতৃত্ব: তিনি মুসলিম সমিতি ও শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন; আধুনিক রাজনৈতিক বিবেক এবং সংগঠিত প্রতিবাদ গঠনে ভূমিকা রাখেন।
  • শিক্ষাগত কর্ম: তিনি মুসলিম শিক্ষাকে আধুনিকভাবে সংশোধন ও সম্প্রসারণে উৎসাহ দেন—এতে মধ্যবর্গীয় মুসলিম শ্রেণীর পুনর্জাগরণ ঘটে।
  • আন্তর্জাতিক সাংগঠনিক ভূমিকা: বাইরের বিশ্বের (ইংল্যান্ড) মাধ্যমে মুসলিম রাজনৈতিক সুবিধা ও নীতিগত বিষয় তুলে ধরে কংগ্রেস–মুসলিম রাজনীতির মাঝখানে একটি যৌক্তিক আলাপসূত্র তৈরি করেন।
    সারসংক্ষেপ: সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের একজন প্রভাবশালী নেতা—তাঁর লেখালেখি, আইনি ও শিক্ষাগত অনুশীলন মুসলিম সমাজকে আধুনিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তচিন্তার দিকে পরিচালিত করেছে। (৯০%—সংক্ষেপে প্রধান অবদানগুলি তুলে দেওয়া হল।)

১। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের পটভূমি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া একটি যুগান্তকারী আইন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটায় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।

পটভূমি:

ভারত স্বাধীনতা আইনের পটভূমি ছিল বহুলাংশে জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। এর প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ভারতে শাসন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ও ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা: ১৯৪২ সালের 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের উত্থান এবং নৌ-বিদ্রোহের মতো ঘটনা ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দেয় যে, ভারতে শাসন করা আর সম্ভব নয়।

ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা: ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন একটি ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠনের চেষ্টা করলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতবিরোধের কারণে তা ব্যর্থ হয়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: ১৯৪৬ সালের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পর থেকে শুরু হওয়া ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্রিটিশ সরকারকে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

অ্যাটলির ঘোষণা: ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাবে।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা: লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে এসে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ভারত বিভাজনের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা 'মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা' বা '৩রা জুন পরিকল্পনা' নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ভারত স্বাধীনতা আইন প্রণীত হয়।

প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ভারত স্বাধীনতা আইন পাস হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল:

বৈশিষ্ট্য

বিবরণ

১. দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হবে।

২. বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা নিয়ে পূর্ব বাংলা এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হবে। একইভাবে পাঞ্জাবকেও বিভক্ত করা হবে।

৩. সংবিধান সভা

উভয় রাষ্ট্রের জন্য পৃথক সংবিধান সভা থাকবে, যা তাদের নিজস্ব সংবিধান প্রণয়ন করবে। নতুন সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্র ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

৪. গভর্নর জেনারেল

উভয় রাষ্ট্রের জন্য একজন করে গভর্নর জেনারেল থাকবেন, যিনি ব্রিটিশ রাজার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। তবে উভয় রাষ্ট্র চাইলে একজন কমন গভর্নর জেনারেলও রাখতে পারত।

৫. রাজকীয় উপাধি বিলোপ

ব্রিটিশ রাজা বা রানীর 'ভারত সম্রাট' উপাধি বিলুপ্ত করা হয়।

৬. দেশীয় রাজ্য

দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। তাদের ভারত বা পাকিস্তানের যেকোনো একটিতে যোগ দেওয়ার অথবা স্বাধীন থাকার অধিকার দেওয়া হয়।

৭. আইন প্রণয়নের ক্ষমতা

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কোনো আইন আর ভারত বা পাকিস্তানের উপর কার্যকর হবে না। উভয় রাষ্ট্রের আইনসভা তাদের জন্য আইন প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করে।

গুরুত্ব:

এই আইনটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে আইনি বৈধতা দেয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করে।

২। লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যালোচনা কর।

লাহোর প্রস্তাব ছিল ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে গৃহীত একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব, যা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। এই প্রস্তাবটি 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামেও পরিচিত।

মূলনীতি:

লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে একটি বা একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। এর মূল বক্তব্য ছিল:

"ভূগোলগতভাবে সংলগ্ন অঞ্চলগুলোকে একত্রিত করে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মতো যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু, সেগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহে (Independent States) পরিণত করা যায়, যেখানে অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।"

এই মূলনীতি থেকে যে ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়:

ভৌগোলিক সংলগ্নতা: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে ভৌগোলিক সংলগ্নতার ভিত্তিতে একত্রিত করতে হবে।

স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ (States): প্রস্তাবে 'রাষ্ট্রসমূহ' (States) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা প্রাথমিকভাবে একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ইঙ্গিত দেয়।

স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব: এই রাষ্ট্রগুলোর অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম।

প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ:

লাহোর প্রস্তাবের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল নিম্নরূপ:

বৈশিষ্ট্য

পর্যালোচনা

১. দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তি

এই প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বি-জাতি তত্ত্বের রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে। এতে বলা হয়, হিন্দু ও মুসলমান দুটি ভিন্ন জাতি এবং তাদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন।

২. একাধিক রাষ্ট্রের ধারণা

প্রস্তাবে 'States' (রাষ্ট্রসমূহ) শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যা উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণাকে ইঙ্গিত করে। যদিও পরবর্তীতে 'পাকিস্তান' নামে একক রাষ্ট্রের দাবি ওঠে।

৩. সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা

প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয় যে, নতুন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে এবং ভারতের অন্যান্য অংশে সংখ্যালঘুদের (যেমন: হিন্দু, শিখ) ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত, কার্যকর ও বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদান করা হবে।

৪. ফেডারেল কাঠামো

প্রস্তাবিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম, যা একটি ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়।

৫. রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ

এই প্রস্তাব মুসলিম লীগের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সুনির্দিষ্ট করে তোলে। এর আগে মুসলিম লীগের লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করা, কিন্তু এই প্রস্তাবের পর তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয় পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

প্রভাব:

লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মোড় নিয়ে আসে। এটি কংগ্রেসের অখণ্ড ভারতের ধারণার বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের চূড়ান্ত অবস্থানকে তুলে ধরে এবং শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকে অনিবার্য করে তোলে।

৩। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার উল্লেখপূর্বক দেশ বিভাগে রাজনীতিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা মূল্যায়ন কর।

লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয়। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে তিনি ভারতে আসেন এবং তাঁর প্রধান কাজ ছিল দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। তাঁর প্রণীত পরিকল্পনাটিই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা বা ৩রা জুন পরিকল্পনা নামে পরিচিত।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (৩রা জুন পরিকল্পনা):

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ছিল ভারত বিভাজনের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি রূপরেখা। এর প্রধান দিকগুলো ছিল:

ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ: ১৯৪৮ সালের জুন মাসের পরিবর্তে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন করা হবে।

বিভাজন নীতি: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে পাকিস্তান এবং বাকি অংশ নিয়ে ভারত গঠিত হবে।

বাংলা ও পাঞ্জাবের ভাগ্য: বাংলা ও পাঞ্জাবের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে প্রদেশগুলো বিভক্ত হবে কিনা। যদি বিভাজনের পক্ষে ভোট পড়ে, তবে একটি সীমান্ত কমিশন (র‍্যাডক্লিফ কমিশন) সীমানা নির্ধারণ করবে।

গণভোট: উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং আসামের সিলেট জেলায় গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে তারা ভারত না পাকিস্তানে যোগ দেবে।

দেশীয় রাজ্য: দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং তারা ভারত বা পাকিস্তানের যেকোনো একটিতে যোগ দিতে পারবে।

দেশ বিভাগে রাজনীতিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা:

লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা বিতর্কিতও বটে।

ভূমিকার ক্ষেত্র

মূল্যায়ন ও প্রভাব

১. দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর

ইতিবাচক: তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে দ্রুত করেন (১৯৪৮ সালের জুন থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্টে নিয়ে আসেন)। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অচলাবস্থা এড়ানো সম্ভব হয়। নেতিবাচক: এই দ্রুততা বিভাজনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়নি।

২. বিভাজনের অনিবার্যতা গ্রহণ

তিনি দ্রুত উপলব্ধি করেন যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয় এবং বিভাজনই একমাত্র সমাধান। তিনি জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার প্যাটেলকে বিভাজনের পক্ষে রাজি করাতে সক্ষম হন।

৩. র‍্যাডক্লিফ কমিশনের ভূমিকা

মাউন্টব্যাটেন সীমান্ত কমিশনের কাজকে প্রভাবিত করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, পাঞ্জাব ও বাংলার কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ভারতকে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

৪. দেশীয় রাজ্যগুলোর সংযুক্তি

তিনি দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন, যা ভারতের ঐক্যবদ্ধকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর নীতি জটিলতা সৃষ্টি করে।

৫. কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের প্রতি কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। তিনি জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

উপসংহার:

লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে একজন নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন। তিনি ভারত বিভাজনকে একটি অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা (মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা) প্রণয়ন করে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তাঁর দ্রুততা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রশংসিত হলেও, বিভাজনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা এবং সীমান্ত নির্ধারণে তাঁর ভূমিকা আজও সমালোচিত হয়।

৪। অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

(এই প্রশ্নটি খ-বিভাগের ৪ নং প্রশ্নের অনুরূপ। এখানে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।)

অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের প্রাক্কালে বাংলাকে একটি পৃথক, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটি প্রচেষ্টা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, এবং আবুল হাশিমের মতো নেতারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। তবে বিভিন্ন কারণে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

ব্যর্থতার প্রধান কারণসমূহ:

কারণের প্রকৃতি

বিস্তারিত আলোচনা

১. কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতা

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, বিশেষ করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তারা মনে করতেন, এটি মুসলিম লীগের একটি কৌশল, যার মাধ্যমে তারা পুরো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। প্যাটেল স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, যদি বাংলা বিভক্ত না হয়, তবে তিনি বাংলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে দেবেন না।

২. মুসলিম লীগের দ্বিধা ও বিরোধিতা

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও, মুসলিম লীগের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে বাংলার মুসলিম লীগের রক্ষণশীল অংশ, পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি বৃহত্তর বাংলা চেয়েছিল, স্বাধীন বাংলা নয়। ফলে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ সমর্থন দুর্বল ছিল।

৩. হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিরোধিতা

হিন্দু মহাসভা এবং বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। তারা স্বাধীন বাংলাকে "মুসলিম আধিপত্য" প্রতিষ্ঠার একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিল এবং বাংলার হিন্দু-প্রধান অংশকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য বাংলা ভাগের দাবি জানায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এই বিরোধিতার নেতৃত্ব দেন।

৪. ব্রিটিশ সরকারের অনীহা

লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তারা একটি জটিল "তৃতীয় রাষ্ট্র" তৈরির প্রস্তাবে আগ্রহী ছিলেন না, যা প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারত। মাউন্টব্যাটেন এই প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেননি।

৫. সাম্প্রদায়িক বিভেদ

১৯৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার পর হিন্দু ও মুসলিম জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ এতটাই তীব্র ছিল যে, তারা একটি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার ধারণার প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। ফলে এই আন্দোলনের কোনো গণভিত্তি তৈরি হয়নি। সাধারণ মানুষ হয় ভারত, না হয় পাকিস্তান—এই দুই বিকল্পের মধ্যেই নিজেদের নিরাপত্তা খুঁজেছিল।

৬. বিলম্বিত উদ্যোগ

এই উদ্যোগটি অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছিল। যখন এই প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়, তখন ভারত বিভাগের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই বিভাজনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল।

উপসংহার:

অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন একটি মহৎ উদ্যোগ হলেও, তীব্র সাম্প্রদায়িক বিভাজন, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা এবং মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বিধার কারণে এটি সফল হতে পারেনি। এর ফলস্বরূপ, ১৯৪৭ সালে বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করে পূর্ব বাংলা (যা পরে বাংলাদেশ হয়) এবং পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হয়।

৫। বাংলায় তিতুমীরের আন্দোলনের স্বরূপ বিচার কর।

তিতুমীরের আন্দোলন (১৭৮২-১৮৩১) ছিল উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় সংঘটিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়।

আন্দোলনের স্বরূপ:

তিতুমীরের আন্দোলনের স্বরূপ ছিল বহুমুখী, যা ধর্মীয় সংস্কার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং রাজনৈতিক প্রতিরোধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

স্বরূপের দিক

বিস্তারিত ব্যাখ্যা

১. ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন

তিতুমীর ছিলেন মূলত একজন ওয়াহাবী মতাদর্শের অনুসারী। তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, যেমন—পীর পূজা, মাজার পূজা, এবং অ-ইসলামিক রীতিনীতি দূর করে ইসলামের বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের দাড়ি রাখা এবং প্রচলিত পোশাক পরিধানের উপর জোর দেন।

২. কৃষক আন্দোলন

এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল বাংলার কৃষক সমাজ। তিতুমীর জমিদার ও নীলকরদের শোষণ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। জমিদাররা তাঁর অনুসারীদের উপর বিভিন্ন অত্যাচারমূলক কর আরোপ করত (যেমন: দাড়ি রাখার উপর কর), যা এই আন্দোলনকে দ্রুত অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে পরিণত করে।

৩. জমিদার ও নীলকর বিরোধী সংগ্রাম

তিতুমীরের আন্দোলন ছিল স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম। তিনি ঘোষণা করেন যে, জমিদারদের খাজনা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর অনুসারীরা জমিদারদের কাচারি আক্রমণ করে এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

৪. ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিরোধ

তিতুমীর নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন এবং নারকেলবাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। যদিও তাঁর আন্দোলন স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম দিকের সশস্ত্র প্রতিরোধের অন্যতম।

৫. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

যদিও এটি একটি মুসলিম সংস্কার আন্দোলন ছিল, তবে এর মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। ফলে অনেক হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে, আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল মূলত অর্থনৈতিক ও শ্রেণীগত, ধর্মীয় নয়।

উপসংহার:

তিতুমীরের আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কারের মোড়কে একটি কৃষক বিদ্রোহ। এটি একদিকে যেমন মুসলিম সমাজের কুসংস্কার দূর করতে চেয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এবং তাদের অনুগত জমিদারদের শোষণ থেকে সাধারণ কৃষকদের রক্ষা করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল। তাঁর আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, এটি বাংলার কৃষক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে।

৬। বাংলায় মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণে সৈয়দ আমীর আলীর ভূমিকা আলোচনা কর।

সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) ছিলেন উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণে একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভূমিকা ছিল মূলত আধুনিক শিক্ষা, রাজনৈতিক অধিকার এবং ইসলামের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে আধুনিক বিশ্বের উপযোগী করে তোলা।

১. রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ:

সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৭): তিনি এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল ভারতীয় মুসলমানদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায় করা এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরা।

রাজনৈতিক সচেতনতা: তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতির বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করতেন, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি মুসলমানদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত।

পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে: যদিও তিনি মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, তবে তিনি মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন, যা পরবর্তীতে মুসলিম লীগের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়।

২. সামাজিক ও শিক্ষাগত পুনর্জাগরণ:

আধুনিক শিক্ষার প্রচার: তিনি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন ছাড়া মুসলিম সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি: তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা মুসলিম সমাজের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা ছিল।

ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ: তিনি মুসলিম সমাজের কুসংস্কার দূর করে একটি প্রগতিশীল সমাজ গঠনে জোর দেন।

৩. ইসলামের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা:

ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা: তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'The Spirit of Islam' (ইসলামের মর্মবাণী) এবং 'A Short History of the Saracens' (সারাসেনদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে এবং মুসলিমদের আত্ম-মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।

ইসলামের প্রগতিশীল ব্যাখ্যা: তিনি ইসলামকে একটি প্রগতিশীল, আধুনিক এবং উদার ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা মুসলিম যুবকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।

উপসংহার:

সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা। তিনি তাঁর লেখনী, আইনি দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদেরকে আধুনিক শিক্ষা, রাজনৈতিক অধিকার এবং আত্ম-মর্যাদার পথে পরিচালিত করেন, যা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে।

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন